সময় যেন খ্যাপা ঘোড়ায় সওয়ার এক বেদুঈন। ছুটছে তো ছুটছেই। পেছন ফিরে তাকালে মনে হয়, এই তো সেদিনের ঘটনা। কিন্তু এর মধ্যে কতবার ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টেছে, ভাবলেও চমকে উঠতে হয়।
এমা ওয়াটসনেরও মনে হয়, এই তো সবকিছুই কদিন আগের ঘটনা। এই তো সেদিন মায়ের হাত ধরে ছোট্ট এমা এলেন স্টেজকোচ থিয়েটারে। মঞ্চে টুকটাক অভিনয় শুরু করলেন। বয়স ১০ বছর পেরোনোর আগে বেশ কয়েকটি মঞ্চ নাটকে অভিনয় করা সারা। সেই মঞ্চে অভিনয়ের সুবাদেই এমার খোঁজ পেল হ্যারি পটারের কাস্টিং দল। এই তো সেদিন নয় বছর বয়সী এমা অডিশনে নাম লেখালেন। আটবারের অডিশন শেষে প্রযোজক ডেভিড হেম্যান তাঁকে কোলে তুলে নিলে বললেন, ‘অভিনন্দন হারমিওনি!’ এমার নাম তক্ষুনি যেন পারলে পাল্টে দেয় হ্যারি পটার টিম। জে কে রাউলিং নিজে অডিশনে এমাকে দেখে প্রশংসাপত্র দিয়ে গেছেন, ‘এই তো আমার কল্পনার হারমিওনি গ্রেঞ্জার!’
জীবনটাকে এমা মনে হয় সত্যিকারে হগওয়ার্টস স্কুল। সব জাদুকরি কাজ কারবার তো এখানেই ঘটে। সেই জাদুকাঠির ছোঁয়াতেই জীবনটা কীভাবে পাল্টে গেছে তাঁর। সেদিনের ছোট্ট হারমিওনি তিনি আর নেই। এই তো আর কদিন পর, ১৫ এপ্রিল তাঁর জন্মদিনের কেকের ওপর লাগবে ২৪টি মোমবাতি। হ্যারি পটার অ্যান্ডি দ্য ফিলোসফার স্টোন যখন মুক্তি পায়, ছিলেন ১১ বছরের ছোট্টটি। রেশম গুঁটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এসে তিনি যেন এখন রঙিন ডানা মেলা প্রজাপতি।
২০১১ সালে মুক্তি পেয়েছিল হ্যারি পটার সিরিজের অষ্টম ও শেষ ছবি। ঠিক এক দশক রাজত্ব করেছে সিরিজটি। এই এক দশকে হ্যারি পটার ছাড়া আর কোনো ছবিই করেননি এমা। অবশ্য ছোট পর্দার জন্য বানানো একটি ছবিতে কাজ করেছিলেন, আর একটা অ্যানিমেশন ছবিতে কণ্ঠ দিয়েছেন। হ্যারি পটার সিরিজটির সঙ্গে সঙ্গেই যেন বেড়ে উঠেছেন। বোর্ডিং স্কুলটায় না হোক, সত্যিকারের জীবনটা ছিল হগওয়ার্টসের সেটে বন্দী। এমনকি পড়াশোনায় ভীষণ সিরিয়াস, দশ বিষয়ের আটটিতেই এ প্লাস নিয়ে জিসিএসই পাস করা এমাকে পড়াশোনাও করতে হয়েছে সেটে, শুটিংয়ে। সেখানেই পড়াতে আসতেন গৃহশিক্ষক, যাঁকে ‘শুটিংস্পট’ শিক্ষক বলাই ভালো। গৃহে তো আর আসতেন না!
স্বাভাবিকভাবেই গা থেকে হারমিওনির খোলসটা খুলে ফেলা খুব সহজ হয়নি এমার জন্য। এরপর একে একে চারটি ছবি করলেন। কিন্তু এর কোনোটাই সেভাবে আলোচনায় এল না। সবাই হ্যারি পটারের সেই চশমা চোখে দিয়েই যেন এমার মধ্যে হারমিওনিকেই খুঁজল। অবশেষে নিজেকে অন্য এক জগতে পৌঁছে দেওয়ার নৌকাটার খোঁজ এমা পেলেন নোয়া ছবির মধ্যে। মার্চের শেষে মুক্তির পাওয়ার পর থেকেই বক্স অফিসের শীর্ষে বাইবেলের কাহিনি আশ্রিত ড্যারেন অ্যারোনফস্কির ছবিটি। অ্যারোনফস্কির চার বছর আগে মুক্তি পাওয়া সর্বশেষ ছবি ব্ল্যাক সোয়ান-ও সমালোচকদের প্রশংসা কুড়িয়েছিল।
প্রশংসিত হচ্ছেন ছবিতে ইলা চরিত্রে অভিনয় করা এমাও। অভিনয়ের প্রতি এমার আত্মনিবেদন দেখেও মুগ্ধ পরিচালক। একটি চুম্বন দৃশ্য বারবার টেক নিতে হয়েছে। গভীর আবেগ নিয়ে সেই দৃশ্যে অভিনয় করতে হয়েছিল। ফলাফল? এমার রক্তাক্ত ঠোঁট! আরেকটি দৃশ্যের শুটিং হয়েছে আইসল্যান্ডে। বিরূপ আবহাওয়ার কারণে বারবার থেমে থেকে শুটিং করতে হয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরেও চরিত্রের ভেতরেই ঢুকে ছিলেন এমা। বাইরের কিছুই যেন স্পর্শ করেনি তাঁকে।
এমা এ রকমই। অভিনয়ও তাঁর কাছে মন্দিরে অর্ঘ্য নিবেদনের মতো পবিত্র একটা কাজ। যে কাজে সামান্য ফাঁকিও দিতে নেই। কিন্তু এও অদ্ভুতভাবে সত্যি, নিজের জীবনটাকে তিনি অভিনয়ের গণ্ডিতে বেঁধে ফেলতে চান না। আর সব তারকারা তাঁর মতো অবস্থানে থাকলে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে ক্যারিয়ারের ইঁদুর দৌড়ে নেমে পড়তেন সেই কবে। কিন্তু এখনো পড়াশোনায় ভীষণ সিরিয়াস এমা ব্রিটেন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে উড়ে এসেছেন লস অ্যাঞ্জেলেসের বাসিন্দা হওয়ার জন্য নয়, ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়তে।
এলি সাময়িকীর এপ্রিল সংখ্যায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে এমা বলেছেন, কেন অভিনয়ের বাইরের একটা জগৎ এত সযত্নে লালন করছেন, ‘কোথায় যেন পড়েছিলাম এলিজাবেথ টেলর বলেছেন, তাঁর জীবনের প্রথম চুম্বনটাই ছিল ছবির শুটিংয়ে, দৃশ্যের প্রয়োজনে। আমি তাই খুব সচেতন ছিলাম, আমার প্রথম চুম্বনটা যেন অন্য কোনো চরিত্রের হয়ে না হয়।’
নিজের জীবনটার সঙ্গে রুপালি পর্দার মোহময় জীবনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলবেন না বলেই প্রেমিক হিসেবেও বেছে নিয়েছেন এই জগতের সঙ্গে সম্পর্ক নেই এমন একজনকে। প্রেম করছেন অক্সফোর্ডের সহপাঠী ম্যাট জেনির সঙ্গে। তাঁর প্রেমের তালিকায় আছে ছবি আঁকা। বই পড়া। থিয়েটার। এমনকি যোগ ব্যায়াম। তাঁর প্রেম অভিনয়ও। তবে সব সময় অভিনয়ের সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে চান না। অভিনয় তাঁর কাছে সেই মহৎ প্রেম, যাহা কাছেই টানে না, দূরেও সরাইয়া দেয়!

0 comments: