Wednesday, 29 October 2014

রাস্তায় ফুল বিক্রি করেন অভিনেত্রী বনশ্রী


এক বন্ধুকে বলছিলাম, বনশ্রীকে খুঁজে পাচ্ছি নাবন্ধুটি রসিকতা করে জবাব দিলো, ‘রামপুরা টেলিভিশন ভবনের কাছে গিয়ে রিকশা নিয়ে বনশ্রী চলে যানকিন্তু রামপুরা যেতে হয়নি কষ্ট করে, ঢাকার শাহবাগেই খুঁজে পাওয়া গেল বনশ্রীকে
দুদিন ধরে শহরে কি এক অদ্ভুত দুষ্টু বৃষ্টি হচ্ছেযেন ফোঁটা ফোঁটা কুয়াশা পড়েএকেই হয়তো বলে শীত বৃষ্টিসেই বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ২৭ অক্টোবর সকালে হাজির হই শাহবাগের ফুল মার্কেটেখোঁজ পাওয়া যায় এখানেই এখন ফুল বিক্রি করেন বনশ্রীহলদে গাঁদা, লাল গোলাপ, সাদা দোলনচাঁপা, রজনীগন্ধা, বেলিসহ নানা ফুলঘেরা পরিবেশে বসে আছেন বনশ্রী
এতক্ষণ শুধু নামটাই বলছি, পরিচয়টা বলা হলো নাবনশ্রী বাংলা চলচ্চিত্রের এক সময়কার জনপ্রিয় এবং পরিচিত এক অভিনেত্রীর নামবাবা মার হাত ধরে ৭ বছর বয়সেই শিবচর থেকে ঢাকায় আসেনবাবা ঠিকাদারি কাজ করতেনদুই বোন আর এক ভাই তারাবনশ্রী ছোটবেলা থেকেই সংস্কৃতি চর্চার মধ্যে ছিলেন উদীচীর সঙ্গে জড়িত ছিলেনভালো গান করতেনঅভিনয় শেখার জন্য সুবচন নাট্য সংসদে যোগ দেন, মহিলা সমিতি মঞ্চের দর্শকের কাছেও পরিচিত মুখ বনশ্রী তারপর বিটিভির স্পন্দনঅনুষ্ঠানে নিয়মিত আবৃত্তি করেছেনপ্রায় দশটির মতো বিজ্ঞাপনচিত্রের মডেলও হয়েছিলেন তিনি

এরপরই চলচ্চিত্রে পা রাখেনসোহরাব-রুস্তমচলচ্চিত্রটির মাধ্যমে তার বাংলা ছবির দুনিয়ায় অভিষেক হয়আর প্রথম ছবিতেই হিরো ছিলেন ইলিয়াস কাঞ্চন এসব গল্প শুনছিলাম বনশ্রীর মুখে, ফুলের ঘ্রাণে মুগ্ধ হয়ে
এরপর তিনি নেশা’, ‘মহাভূমিকম্প’, ‘প্রেম বিসর্জন’, ‘ভাগ্যের পরিহাসনামের চলচ্চিত্রগুলোতে অভিনয় করেনতিনি বলেন, ‘চলচ্চিত্রে যখন কাজ শুরু করি, তখন থেকেই আমার টার্গেট ছিল জনপ্রিয় হিরোদের সঙ্গে কাজ করবোতাই আমি মান্না, অমিত হাসান, রুবেল এদের নায়িকা হয়ে কাজ করেছি
চলচ্চিত্র প্রযোজক ফারুক ঠাকুরই তাকে ঢাকাই চলচ্চিত্রে ব্রেক দিয়েছিলেনসব কিছু ভালোই চলছিলআলিশান বাড়ি, জীবন-যাপনকিন্তু ফারুক ঠাকুর একটি খুনের মামলার আসামি হয়ে আত্মগোপন করলে একে একে সবাই সরে যান বনশ্রীর পাশ থেকেধীরে ধীরে বনশ্রীও শ্রীহীন হয়ে পড়েন রূপালী জগৎ থেকে তারপর শুরু হয় তার সংগ্রামী জীবনের পথচলানতুন এক গল্প
নিষ্ঠুর দুনিয়া নামে একটি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছিলেন তিনিকিন্তু ছবিটি শেষ পর্যন্ত মুক্তি পায়নিএকসময়কার সেই ব্যস্ততম অভিনেত্রী এখন ফুটপাতে বসে ফুল বিক্রি করেনকেন এই ফুল বিক্রি? এবার বনশ্রী বলেন, ‘দেখুন আমি এর আগে বাসে বাসে বই বিক্রি করে সংসার চালাতামসংসার বলতে আমি আর আমার সাড়ে তিন বছরের ছেলে আপন [মেহেদী হাসান আপন]কিন্তু ছেলেকে কোলে নিয়ে বাসে বাসে বই বিক্রি করাটা কষ্টেরএত কষ্ট আমি সহ্য করতে পারছিলাম নাতাই ছেলেকে এতিমখানায় দিয়ে, এখন ফুল বিক্রি করছিআমি যখন নায়িকা ছিলাম, তখন প্রায় প্রতিদিনই ঢাকা ক্লাবে আসতাম কাজ না থাকলেসেই ঢাকা ক্লাবের টেনিস মার্কার হিসেবে কাজ করতেন জীবন ভাইতিনি একদিন আমাকে রাস্তায় দেখে বললেন, ‘আরে ম্যাডাম আপনি কেন বাসে বাসে বই বিক্রি করবেনতখন তিনি আমাকে ফুল বিক্রি করার কাজ দেন

নিজের ক্যারিয়ার নষ্ট, সংসারও টিকলো না, মেয়ে বৃষ্টিকে হারালেন, এখন একমাত্র সম্বল শিশু সন্তান আপনকেও ঠিকমত লালন পালন করতে পারছেন নাএসব নানা কারণে বনশ্রী এর মাঝে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েনপরে তিনি মানিকগঞ্জের আসক্তি পুনর্বাসন নিবাস আপনে চারমাস মানিসক চিকিৎসা নেনআর ছেলেকে দিয়ে দেন সাভারের একটি এতিম খানায়
বনশ্রী বই বিক্রেতা থেকে ফুল বিক্রেতা, এক সময় থাকতেন আলিশান ফ্ল্যাটে এখন শেখের টেকের বস্তিতেছেলে থাকে এতিমখানায়, তিন বেলা খাবারের নিশ্চয়তা নেইএই পরিস্থিতির জন্য কাকে দায়ী করবেন আপনি? ফুলের রাজ্যে বনশ্রী উত্তর খুঁজে বেড়ানতিনি বলেন, ‘দেখুন আমার আসলে সঠিক কোনো গাইড ছিল না বা আমাকে বুদ্ধি পরামর্শ দেয়ার লোক ছিল নাফারুক ঠাকুর যখন ঝামেলায় পড়েন আমি তখন একা হয়ে যাইআমার কোনো ব্যাকআপ ছিল নাআমার বাবা মার কাছ থেকেও আমি কোনো সঠিক দিক নির্দেশনা পাইনিএই শহরে একা একটি মেয়ে টিকে থাকার জন্য যে কী লড়াই করতে হয় তা আপনাদের জানা নেই
[চোখের কোনে বনশ্রীর পানিতিনি কান্না আড়াল করেন ওড়নায় মোছেনকণ্ঠ ভারি হয়ে আসে তার] তিনি আবার বলা শুরু করেন, ‘আমার এখন কুত্তা বিলাইয়ের মতো জীবন যাপন করতে হচ্ছেএটা কি আমার অপরাধের জন্যনাকি আমাদের চারপাশের সিস্টেমের জন্য? আমার সংসার, আমার সন্তান, স্বামী কিছু নেই এখন আমার
[আবার চুপ হয়ে যান বনশ্রী]

আচ্ছা এর মাঝে শুনেছিলাম আপনাকে নায়ক অনন্ত জলিলসহ অনেকেই সহযোগিতা করেছেনতারা অর্থ সহায়তা দিয়েছেন
এবার যেন একটু রেগে গেলেন বনশ্রী, ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন, ‘অনেকেই টাকা দিয়েছে, অনন্ত জলিল দিয়েছেন ১৩ হাজার টাকা, ইলিয়াস কাঞ্চন দশ হাজার টাকা, চ্যানেল আই থেকে এবং আরো একটি প্রতিষ্ঠান কিছু টাকা দিয়েছিলকিন্তু তা খুবই সামান্যআমার এ টাকার দরকার নেইআমি গেলাম অনন্ত জলিলের অফিসে, গিয়ে তাকে বললাম, আমাকে চাকরি দেয়ার জন্যকারণ আমি সেলাইয়ের কাজ জানিতিনি আমাকে চাকরি দিলেন নাতার অফিসের দারোয়ান আর ড্রাইভার আমার সঙ্গে অভদ্র আচরণ করেছে, অপমান করেছেএরপর একদিন অনন্ত জলিল আমাকে বললেন, তিনি প্রতি মাসে আমাকে এক হাজার টাকা দেবেন আর ১৫ কেজি চালকিন্তু আজ পর্যন্ত আমি তা পাইনিআমি তো ভিক্ষা চাই নাআমাকে কাজ দেনতাও কেউ আমাকে কাজ দিচ্ছে নাতাই আমি ফুলের ব্যবসায় নেমেছিএখানে যদি আমাকে সবাই সহযোগিতা করে আশা রাখি ফুলের ব্যবসাটা দাঁড় করাতে পারবোআমি সবাইকে অনুরোধ করবো আমার ফুলের দোকান থেকে ফুল নিতেসব রকমের ফুল আমি সরবরাহ করবো

বনশ্রী আরো জানান, তার ফুলের দোকানের নাম ঠিক করেছেন চন্দ্রমালিকা পুষ্প কুঞ্জশাহবাগের ফুল মার্কেটেই তিনি একটি ফুলের দোকান নিতে চানকিন্তু তার অর্থ নেইতাই এখন ফুটপাতেই বসে ফুল বিক্রি করছেনবনশ্রীর স্বপ্ন ফুলের দোকানটা দাঁড় করাতে পারলে শিশু সন্তান আপনকে নিজের কাছে নিয়ে আসবেন তিনি বলেন, ‘ছেলেটা এতিমখানায় গিয়ে সব সময় মনমরা হয়ে থাকেবুকটা ফেটে যায় ছেলের মুখ দেখলেছেলের জন্য অশান্তি লাগেটাকা হলেই ভালো থাকার জায়গা পেলেই ছেলেকে নিয়ে আসবো
আপনি তো এর মাঝে মাটির পরীনামে একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেনঅভিনয়টা কি করতে চান না আর?
একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বনশ্রী বলেন, ‘মাটির পরী চলচ্চিত্রে আমাকে দিয়ে অভিনয় করিয়ে ফকিরের মতো এক হাজার টাকা ধরিয়ে দিছেএরকম হলে কি কাজ করা যায় বলেনআমার মনে প্রাণে তো অভিনয়আমি তো অভিনয় করতেই চাই কিন্তু ভালো সুযোগ পাচ্ছি নাআর অভিনয় করতে গেলেও তো খরচ লাগেসেটাও তো আমার কাছে নাই

কথা হচ্ছিলে ফুল মার্কেটে বসেইবনশ্রীকে এই মার্কেটের সবাই আপন করে নিয়েছেনকিন্তু বনশ্রী কি ফুল ক্রেতা না বিক্রেতা এটা অনেকেই বুঝতে পারেন নারাস্তায় দাঁড়িয়ে বসে ফুল বিক্রি করতে সমস্যা হয় তারতাই টাকার অপেক্ষায় আছেনটাকা জমিয়ে দোকান দিবেন তিনিছেলেকে নিয়ে আসবেনবনশ্রীর এই ছোট্ট স্বপ্ন পূরণ হোক সেই কামনা থাকলোফুলের ঘ্রাণে ফুলের রঙে ভরে উঠুক বনশ্রী আর তার শিশু সন্তান আপনের জীবন


SHARE THIS

Author:

Facebook Comment

0 comments: