একটা সময় ছিল, যখন সবাই হলে গিয়ে বাংলা সিনেমা দেখতো। সে সময়টা কোথায় যে পালিয়ে গেছে! এর জন্য ভীনদেশী সিনেমা বিশেষ করে হিন্দি সিনেমার সহজলভ্যতা, ডিশ অ্যান্টেনার প্রভাব সহ যতগুলো কারণ দায়ী- তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে বাংলা চলচ্চিত্রে অশ্লীলতার ছোঁয়া। মধ্যিখানে বেশ কিছুদিন অবশ্য ভাল কিছু সিনেমা নির্মিত হয়েছিল। দর্শকরা যেতে শুরু করেছিল সিনেমা হলে। সময়টা খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। আবার শুরু হয়েছে অশ্লীলতা। এখনকার ছবিতে ‘আইটেম গান’ না রাখলে নাকি হিট হয়না! সেই গানের কথা, নাচানাচি এতটাই অশ্লীল হয় যে- ‘ছি:’। এর শেষ কোথায়? উত্তর কি জানা নেই কারও!
গ্রীষ্মের ভর দুপুর। বাসের জন্য অপেক্ষা। দাঁড়িয়ে ছিলাম ‘সনি সিনেমা হল’ এর ঠিক সামনেই। ঢাকায় বসবাসরত অধিকাংশ বাংলা সিনেমার দর্শকই হলটির নাম শুনেছেন। চেনেনও হয়তো ভাল করে। নজর গেল দেয়ালে ঝুলে থাকা পোস্টারের দিকে। ঘাম ঝরানো রোদের চেয়েও যেন রগরগে এই পোস্টার! ছবির নাম ‘দাবাং’। বলিউড সিনেমা ‘দাবাং’ নয় কিন্তু! এটা আজাদ খান পরিচালিত বাংলা ছবি ‘দাবাং’। ছবিটির পোস্টারের হাল-ই যদি এই হয়, তাহলে এটিকে নি:স্বন্দেহে যে কেউ ‘অশ্লীল’ বলতে বাধ্য। এমন ‘অশ্লীল’ পোস্টার গত ক’বছর দেখা যায়নি খুব একটা। নিয়মিত দেখা যেত মুনমুন, ময়ূরী, পলি, ঝুমকা সহ ‘অশ্লীল নায়িকা’ ট্যাগ প্রাপ্তদের আমলে। কেমন আছেন এখন তাঁরা! কিভাবে আছেন?
মুনমুন: পর্দায় মুনমুনের আবির্ভাব ঘটে ২০০০ সালের পর। বলা চলে, তাঁর হাত ধরেই মূলত বাংলা চলচ্চিত্রে ভর করে অশ্লীলতা। একের পর এক ছবিতে তাঁর খোলামেলা উপস্থিতি সুস্থ ধারার দর্শকদের বিব্রত করতো। অথচ তাঁকেই আদর্শ মেনে তখন একই পথে হাঁটতে শুরু করেন এক ঝাঁক অভিনেত্রী। একপর্যায়ে বাংলা চলচ্চিত্র থেকে নিষিদ্ধ হন তিনি। ‘নিষিদ্ধ নারী’ খ্যাত এই নায়িকা বাস্তব জীবনে তিনবার বিয়ের পিঁড়িতে বসলেও টিকেনি শেষ পর্যন্ত একটাও। তাঁকে এখন খুঁজে পাওয়া মেলা ভার। আগের সব নাম্বারই বন্ধ। তিনি নাকি এখন প্রচন্ড ধার্মিক বনে গেছেন! হিজাব ছাড়া বের হননা বাইরে। নিয়মিত নামাজও পড়ছেন। চলচ্চিত্র জগৎ থেকে ছিটকে যাওয়ার পর তিনি যাত্রাপালায় অশ্লীল নাচেও অংশ নিয়েছিলেন। অথচ, এখন যেন ঠিক নিজের বিপরীতেই অবস্থান নিয়েছেন এককালের পর্দা কাঁপানো ‘অশ্লীল’ এই অভিনেত্রী।
ময়ূরী: নব্বই দশকের শেষ দিকে প্রচন্ড হিট নায়িকা ছিলেন ময়ূরী। অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হয়ে চলচ্চিত্রাঙ্গন থেকে সরে গেছেন অনেকদিন আগে। এরপর ছিলেন লোকচক্ষুর অন্তরালে। তাঁর ব্যবহার করা মোবাইল নাম্বারটিও বন্ধ। অনেকটা হুট করেই সেদিন তাঁকে দেখা গেল যশোরের মধুমেলায়। বেড়াতে বা কবির টানে নয়, মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্মরণে মধুমেলায় শুক্রবার তিনি এসেছেন ‘নিউ সুপার সার্কাস পার্টি’ দলের একজন হিসেবে। তবে তিনি কথা বলতে রাজী হননি কোনো বিষয়েই। অথচ যখন সিনেমায় নিয়মিত কাজ করতেন তিনি, তখন কাজের কাছে হার মানতো খাওয়া-ঘুম। এতোটাই ব্যস্ত ছিলেন। মাসের তিরিশ দিনে ৬০শিফট শ্যুটিং। অনেক দিনই নাকি তিনি ঘুমিয়েছেন গাড়িতেই, এক স্পট থেকে অন্য স্পটে শ্যুটিংয়ে যাবার সময়। অশ্লীলতাই কাল হলো তাঁর। হিট নায়িকা থেকে হতে হলো ‘সার্কাস কণ্যা’।
এই মুনমুন, ময়ূরী ছাড়াও ‘অশ্লীল’ নায়িকা ট্যাগধারী যারা যারা ছিলেন তখন, অশ্লীলতার পুরো দোষটাই কি তাদের ছিল? নাকি ওইসব ছবিগুলোর সাথে সংশ্লিষ্টদের পুরো দোষ ছিল? বিভিন্নরকম যুক্তি-তর্ক থাকতেই পারে প্রশ্নগুলোর উত্তরে। তবে কেউই পুরোপুরি ‘সাধু’ ছিলনা, সেটা বলা যায় নি:সঙ্কোচে। সে সময় দেশের চলচ্চিত্রাঙ্গনে ছিল অস্থির পরিবেশ। সেই পরিবেশটা ভাল হয়েছিল কিছুদিনের জন্য। আবার হলো টা কী! ক্রমেই বেড়ে চলছে অশ্লীলতা। অনেকেই চলচ্চিত্রে পুরোপুরি ভাবে আসার আগে থেকেই নিজের নামের পাশে ‘অশ্লীল’ ট্যাগটা লাগিয়ে নিচ্ছে ইচ্ছে করেই। অবশ্য, যুগ পাল্টাচ্ছে। সেই সাথে পাল্টে যাচ্ছে অনেক কিছুই। এখন ‘অশ্লীল’ শব্দটার বদলে ব্যবহার করা হয় ‘সাহসী’। শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো অবস্থা। টুকটাক মডেলিং করতে শুরু করেই এখন যারা নায়িকা হওয়ার স্বপ্ন দেখেন, তাদের অধিকাংশই ‘সাহসী’ অভিনয়ে প্রস্তুত বলে জানিয়ে দেন মিডিয়াপাড়ায়। সেটা সামনাসামনিই হোক, কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেই হোক। যার প্রমাণ তো অসংখ্যই আছে। শুধু একজনের কথাই বলি।
নায়লা নাঈম: পেশায় দন্ত চিকিৎসক। ২০০৯ সালে গ্রামীণফোনের বিজ্ঞাপনচিত্রে মডেল হিসেবে কাজ করার মাধ্যমে অলোচনায় আসেন তিনি। একজন ফ্যাশন মডেল হিসেবে, পাশাপাশি একাধিক ব্র্যান্ডের টেলিভিশন বিজ্ঞাপনে কাজ করেছেন। পরবর্তিতে টেলিভিশন নাটকেও অভিনয় শুরু করেন। ‘ভাইকিংস’ সংগীতদলের তন্ময় তানসেনের মুক্তি প্রতিক্ষিত ‘রান আউট’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো দেখা যাবে তাঁকে বড় পর্দায়ও। ফেসবুকে বেশ কিছু খোলামেলা স্থিরচিত্র প্রকাশের কারণে বারবার অনলাইন পত্রিকাগুলোর শিরোনাম হয়েছেন তিনি। কেউ কেউ তাঁকে ‘বাংলার সানি লিওন’, ‘পর্নো স্টার’ বলতেও ছাড়েননি। এই সমালোচনার বিপরীতে লিখেছেন তিনি ফেসবুকেই। ‘আমি পর্নো স্টার নই। পর্নো মুভি তো দূরের কথা, আমি কোনো নগ্ন শ্যুটও করবো না।’ দায় শেষ এটুকুতেই! খোলামেলা ছবি প্রকাশ করা তো কমেনি! তাঁর হট প্যান্ট, শর্ট টপস এবং বিকিনিতে তোলা বেশ কিছু ছবি সত্যিকার অর্থেই পর্নো স্টার ‘সানি লিওন’কেও হার মানায়। এরই মধ্যে তাঁর করা একটি ভিডিও গান নিয়েও তোলপার হয়েছে বেশ। বাংলাদেশের খুব কম গানের ভিডিওতেই এমন ‘অশ্লীল’ পোশাক, ‘অশ্লীল’ অঙ্গভঙ্গি ব্যবহৃত হয়। তাঁকে দেখলে বোঝাই যায়না সে বাংলাদেশের নাকি পাশ্চাত্যের মডেল!
নায়লা নাঈমের মতো শুধু নতুনরাই না, এখন যারা পর্দা কাঁপাচ্ছেন- তাদের মধ্যে অনেকেই বেরোতে পারছেননা অশ্লীলতার গন্ডি থেকে। তাদের পোশাক, কথা বলার ধরণ, অঙ্গভঙ্গি- সবকিছুই ‘অশ্লীল’। তাদের মধ্যে শীর্ষে থাকা দুজনের কথা না বললেই নয়।
ববি: পুরো নাম ইয়ামিন হক ববি। প্রথমবার বড় পর্দায় আসেন ‘খোঁজ-দ্য সার্চ’ ছবির মাধ্যমে। এ পর্যন্ত বেশ কিছু ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। ‘দেহরক্ষী’ ছবিটি তাঁকে চলচ্চিত্রাঙ্গনে পরিপূর্ণ অভিনেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করে। এই ‘দেহরক্ষী’তে তাঁর খোলামেলা অভিনয় বিব্রত করে সুস্থধারার দর্শকদেরকে। শুধু তাই নয়, সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত ‘রাজত্ব’ ছবিতেও তিনি যথেষ্ট খোলামেলা অভিনয় করেছেন। ক’দিন আগে এক পরিচালকের সঙ্গে ববির একটি অশ্লীল ভিডিও ফাঁস হয়েছে বলে গুঞ্জনও উঠেছে বেশ জোরেশোরে। ভিডিওটি প্রথমে ইউটিউবে পাওয়া গেলেও কয়েক ঘন্টা পরেই তা মুছে ফেলা হয়।
মাহিয়া মাহী: ‘ভালবাসার রং’ ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় মাহীর। তিনি জন্মেছেন রাজশাহী বিভাগে। চলচ্চিত্রে অভিনয়ের কোনো ইচ্ছেই ছিল না তাঁর। শিশুবেলা থেকে ডাক্তার হতে চেয়েছিলেন। তবে, মডেলিং করার আগ্রহ ছিল। সেই মাহী-ই কিনা প্রায় প্রতিটি ছবিতেই অভিনয় করে যাচ্ছেন খোলামেলা পোশাকে! ‘জাজ মাল্টিমিডিয়া’র কর্ণধার এমনকি নায়ক বাপ্পিকে ঘিরেও ইতিমধ্যেই মিডিয়াপাড়ায় তাঁর নামে ভেসে বেড়াচ্ছে একাধিক গুঞ্জন। গত ৬ মে এফডিসিতে শ্যুটিং ছিল সাফিউদ্দিন সাফি পরিচালিত ‘বিগ ব্রাদার’ ছবিটির। সেদিনও তিনি যথেষ্ট খোলামেলা পোশাকেই শ্যুটিং করেছেন।
শেষকথা- যুগের দোষ দিয়ে, বলিউড-হলিউডের দোষ দিয়ে, সময়ের চাহিদার দোষ দিয়েই কি এড়িয়ে যাওয়া যায় সবকিছু? না। ইতিহাসের পাতায় পাতায়-ই তো লেখা হয়ে যাচ্ছে গল্প। এই গল্পই যে একদিন কঠিন প্রতিশোধ নেবেনা, তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে? ময়ূরী, মুনমুন, পলিরা কি জানতেন যে একদিন তাদেরকে আজকের এই কঠিন অবস্থানে এসে ঠেঁকতে হবে? এখনকার ববি, মাহী, নায়লারা যে একদিন ময়ূরী, মুনমুনদের অবস্থায় এসে ঠেঁকবেনা- তার নিশ্চয়তাই বা কে দেবে? এই সময়! যুগ! নাকি বলিউড-হলিউড! ভাবতে হবে এখনই। দেশের চলচ্চিত্রশিল্পকে, দেশীয় সংস্কৃতিকে ভীনদেশীদের কাছে বিকিয়ে দিলে তো চলবেনা। নিজেদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতেই হবে। চলচ্চিত্রাঙ্গনকে সুস্থ রাখতেই হবে। তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ যা যা নেয়ার, যাদের যাদের নেয়ার- আশা করি তারা খুব দ্রুতই আত্ম-উপলব্ধি করতে পারবেন। বাংলা চলচ্চিত্রকে অশ্লীলতার হাত থেকে, ধ্বংশের পথ থেকে বাঁচাবেন।

0 comments: